সোমবার, ২৩ Jun ২০২৫, ০৭:১৩ অপরাহ্ন
দৈনিকবিডিনিউজ৩৬০ ডেস্ক : রাজধানীর বিজয় সরণির মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের কারণে আটকে আছে শত শত গাড়ি। কোনও বলা-কওয়া ছাড়াই হঠাৎ করে পাশের ফুটপাত থেকে ৫-৬ জন শিশু রাস্তায় নেমে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেল এবং প্রাইভেটকার একের পর এক মুছতে শুরু করে। এরপর শুরু করে ভিক্ষা চাওয়া। তাদের আচমকা এমন আচরণে গাড়িতে বসে থাকা মানুষেরা কিছুটা বিব্রত বোধ করেন, তারপর যেন অনেকটা বাধ্য হয়েই ভিক্ষা দেন। শুধু বিজয় সরণির মোড়েই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে দেখা মেলে প্রায় একই চিত্র। মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই নতুন এই কৌশলে ছোট ছোট শিশুরা প্রতিনিয়ত ভিক্ষাবৃত্তি করছে। সিগন্যাল উঠে যাওয়ামাত্র গাড়ি চলতে শুরু করলে এই শিশুরা পাশের ‘বিজয় সরণি ফোয়ারা’র নিচে গিয়ে অবস্থান নেয়। বৃহস্পতিবার (১৩ আগস্ট) বিকালে সেখানে কথা হয় আকলিমা, রিফাত, সায়েম, রুবেল, মারুফ ও পরশের সঙ্গে। তাদের কারও বয়সই ৮ বছরের বেশি নয়। এই শিশু ভিক্ষুকরা জানায়, তারা সবাই তেজকুনিপাড়া বস্তির বাসিন্দা। ভিক্ষা করার কারণে দিনের বেশিরভাগ সময় তাদের কাটে বিজয় সরণির ৮ রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালে। দেখা গেলো, বিকাল শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেও তাদের কারোরই বাসায় ফেরার তাড়া নেই।
এই শিশুরা জানায়, দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে তারা সবাই স্কুলে যেতো। তখন মাঝে মধ্যে বিভিন্ন দোকানে গিয়ে ভিক্ষা করতো। কিন্তু করোনার কারণে এখন তাদের স্কুল বন্ধ। একই কারণে রাজধানীর বেশিরভাগ দোকানও বন্ধ রয়েছে। তাই তারা এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি রাস্তার মোড়ে, সিগন্যালে ভিক্ষা করছে। এমনকি দুপুরে খাওয়ার জন্য সবদিন বস্তিতেও যাওয়া হয় না। ভিক্ষা করে পাওয়া টাকায় ফুটপাত থেকে আমড়া, পপকন, আলুর চিপস কিনে খেয়েই দিন পার করে দেয়। রাতে বস্তির বাসায় গিয়ে ভাত খায় তারা।
গাড়ি মুছে দিয়ে টাকা চাওয়ার এই কৌশল তাদের কে শেখালো জানতে চাইলে রুবেল বলে, ‘কেউ শেখায়নি। আমরা নিজেরাই এটা শুরু করেছি। এমনে চাইলে মানুষ ভিক্ষা দেয় না। তাই গাড়ি মুছে দিয়ে টাকা চাই। তখন দেয়।’
তোমাদের তো কেউ গাড়ি মুছতে বলে না, তাহলে কেন এটা করো প্রশ্নে রুবেল চুপ থাকে। পাশ থেকে রিফাত বলে, ‘গাড়ি মুছে দিলে স্যারেরা খুশি হয়ে টাকা দেন। এই জন্য মুছে দেই।’ বস্তিতে দাদির সঙ্গে থাকে মারুফ। মা তার মারা গেছে ডায়াবেটিসে জানিয়ে মারুফ বলে, ‘বাবা রিকশা চালান। কিন্তু সব সময় দাদিকে টাকা দেন না। দাদি আগে মানুষের বাসায় কাজ করতেন। এখন কাজ কমে গেছে।’ মারুফ এখন প্রতিদিন ৩০-৪০ টাকা করে দাদিকে দেয়। শুধু মারুফ নয়, তারা প্রত্যেকেই দিন শেষে ভিক্ষা থেকে আয়ের একটা অংশ তাদের সংসারে দিয়ে থাকে। স্কুল খুলে গেলে তারা কি ফিরে যাবে জানতে চাইলে আকলিমা বলে, ‘মা বললে যাবো। না হলে আর যাবো না।’ এই শিশুদের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তার পাশেই আমড়া বিক্রি করছিলেন মো. কামাল। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে এই শিশুদের সঙ্গে তাদের মায়েরাও এখানে আসতেন। কিন্তু গত ১-২ মাস থেকে শিশুরা নিজেরাই সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত একা-একা সিগন্যালে এভাবে ভিক্ষা করে। দুপুরের দিকে গরম বেশি পড়লে ফোয়ারার পানিতে গোসল করে নেয়। সারাদিন ওরা এখানে থাকে।’
তেজগাঁওয়ে নাবিস্কোর মোড়ে প্রধান সড়কে গাড়ি মুছে দিয়ে ভিক্ষা করছে শিশু হানিফ, বয়স আনুমানিক ৪-৫ বছর। হানিফ জানায়, তার ভাইও সিগন্যালের পাশের রাস্তায় (সাত রাস্তার দিকে যাওয়ার সড়কে) তার মতো একই কাজ করছে। বেগুনবাড়ি বস্তিতে মায়ের সঙ্গে থাকে তারা। হানিফদের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। সেখানেও তার আরেকজন মা আছেন। হানিফও কিশোরগঞ্জে থাকতো এবং স্কুলেও যেতো। ঈদের সময় ঢাকার মা বাড়িতে গিয়ে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে, জানালো হানিফ। জুলাই মাসে প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর প্রায় এক কোটি শিশু আর স্কুলে ফিরে যেতে পারবে না। শিক্ষা তহবিল কাটছাঁট ও দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এই বিরাট সংখ্যক শিশু স্কুল থেকে ঝরে যাবে। ‘শিক্ষার লুপ্ত সংকটাপন্ন অবস্থা’য় গরিব শিশুদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। আর শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার কারণে অনেক দরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুলে যেতে পারবে না। পরিবারে অভাবে কারণে তারা ভিক্ষায় নেমে পড়েছে। আবারও অনেকে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়বে। বস্তির শিশুরা বেশি ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত হবে।’’
এসএস